এই লেখাটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য
বিশ্ববিদ্যালয়ে তো ভর্তি হয়ে গেলে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থটা কী?
বিশ্ববিদ্যালয়ের যথার্থ সংজ্ঞা নিয়ে নানা বক্তব্য আছে দুনিয়াজুড়ে। এর মধ্যে আমার কাছে একটা গ্রহনযোগ্য সংজ্ঞা হল, মনটা কে বিশ্বের মত বড় করে চিন্তা করতে পারা যায় যে পর্যায়ে গিয়ে, সেটার নাম বিশ্ববিদ্যালয়।
এর মানে হল, মনটাকে বড় করে করতে হবে অন্তত চার-পাঁচ বছর ধরে। কখনো তার থেকেও বেশি সময় নিয়ে। সেটা একাডেমিক জ্ঞানের দিক থেকে হোক, সহশিক্ষায় মেধার চর্চার দিক থেকে হোক, কিংবা হোক সামাজিক চিন্তার দিক থেকে।
এটা কিভাবে করা যেতে পারে?
প্রথম কথা, উচ্চাকাঙ্ক্ষার সাথে পড়ালেখা করতে হবে। এমন না যে সবাইকে নিজের ফিল্ডের সেরা মানুষ হতে বলছি। এটা সবসময় সম্ভব-ও না। কিন্তু যা খুবই সম্ভব, তা হল, নিজের পড়ালেখাকে উপভোগ করা। প্রাসঙ্গিক চলচ্চিত্র, গল্পের বই বা নিজের ফিল্ডের পন্ডিতদের জীবনী পড়ো৷ এতে অন্তত নিজের পড়াশুনার বিষয়কে অর্থহীন মনে হবে না। রিলেট করতে পারবে অনেক কিছুকেই।
দ্বিতীয় কথা, চিন্তাকে প্রসারিত করো। অন্য কোন ডিপার্টমেন্টের বিষয়কে বা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে ছোট করা খুবই অপ্রয়োজনীয় কাজ। বরং যা প্রয়োজনীয়, তা হল, সেই বিষয়গুলোর অবদান সম্পর্কে কিছুটা ধারণা রাখা৷ তাতে তোমার জ্ঞানের পরিধিও বাড়বে৷
ধরো, তুমি কোন ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থী। তোমার ধারণা, দর্শন, ইতিহাস বা মনোবিদ্যা কোন বিষয়ই না- কারণ এগুলো অতি সহজ!
এখন একদম বেসিক Google করো, “Why reading philosophy is necessary? "
গুগলের রেজাল্টে যা যা জানবে, তাতে তোমার চোয়াল ঝুলে যেতে পারে! একই সাথে এটাও বুঝতে পারবে যে, পৃথিবীতে যে কত কিছু জানার আছে আর আমরা কত স্বল্প বিষয় জেনেই মনে করি, “অমুক ডিপার্টমেন্টে জব কম, তাই এই ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট সবাই খারাপ!”
তৃতীয়ত, সামাজিক বিজ্ঞানের দিকগুলো জানার চেষ্টা করো। একাডেমিক কন্টেন্টের কথা বলছি না। বলছি একদম বেসিক কিছু ইস্যুর কথা- ভিন্ন জেন্ডারের প্রতি তোমার দৃষ্টিভঙ্গি , দেশের দারিদ্র্য সমস্যা, সাধারণ রাজনৈতিক সমস্যাগুলো। এগুলো কিন্তু দৈনিক পত্রিকা পড়েই জানা যায়। তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ো- আর তাই তোমার যেন মনে থাকে ধর্ষণের জন্য ধর্ষক নিজে দায়ী এবং দেশের শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দায়ী। মনে রাখতে হবে, ধর্ষণের ভিকটিমের উপর দোষ চাপিয়ে দেওয়ার কোন যৌক্তিকতা নেই!
এটা তো কেবল একটা উদাহরণ। দিনশেষে তুমি বাংলাদেশের একজন শিক্ষার্থী। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি জেনেই তোমাকে এই দেশে কাজ করতে হবে- সেই কাজ কর্পোরেট চাকরি হোক বা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির গবেষণা হোক।
চতুর্থত, কৌতূহলী হও। সবাইকে গবেষক হতে বলছি না। কিন্তু ভালো গবেষণাকে এপ্রিশিয়েট করতে বলছি। গবেষণাকে এই দেশে পাত্তা দেওয়ার মানুষ কম। তুমি অন্তত সেই মানুষটা হতে যেও না। গবেষণার ফান্ডিং এই দেশে কম, তার একটা বড় কারণ, গবেষণার ফান্ড দিয়ে এক ঝলকে একটা ব্রিজের পিলার দেখানো যায়না। গবেষণায় বরাদ্দকৃত অর্থের ফলাফল আসতে শুরু করে অনেক দেরিতে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, নিজে গবেষণা করা কিংবা গবেষণাকে এপ্রিশিয়েট করাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম। বিশ্বজুড়ে উন্নত দেশগুলো উন্নত হওয়ার একটা বড় কারণ, গবেষণা ক্ষেত্রে তাদের ফান্ডিং। তুমি তো ফান্ডিং বা বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ আচমকা বদলে দিতে পারবে না। কিন্তু নিজেকে একসময় এতটাই দক্ষ করে তুলতে পারো যে, নিজেকে ফান্ডিং এর দাবিদার হিসেবে তুলে ধরতে পারো। আবার, গবেষণা-সমঝদার হয়ে উঠতে পারলে হয়তো তুমিই একসময় দেশের নীতিনির্ধারক হয়ে গবেষণার বাড়তি অর্থায়ন করতে পারো।
তাই, জানার চেষ্টা করো গবেষণা নিয়ে।
সবশেষে, বৈশ্বিক পর্যায়েও নিজেকে চিন্তা করতে হবে। এখন এটা জানা খুব সহজ। নিজের ফিল্ডে অন্য দেশের যেসব তরুণ ভালো কাজ করছে, তাদের খবরাখবর জানার চেষ্টা করো। সেই দক্ষতাগুলো নিজের মধ্যে আয়ত্ত করো। এমনও হতেই পারে যে, কিছুদিন পড়াশুনার পর তুমি বুঝলে যে, তুমি নিজের ডিপার্টমেন্টাল ফিল্ডে কাজ করতে চাও না। অন্য কিছু করতে চাও। সেই অন্য কিছু করার জন্য কি করা লাগবে, সেটাও ধীরে ধীরে জানার চেষ্টা করো।
তথ্যের এই যুগে ইনফর্মড ডিসিশন, ইনফর্মড থট প্রসেসিং আর প্রোপার নোলেজ গ্যাদারিং ভীষণ ভীষণ জরুরি। আশা করি, উৎসাহের সাথেই কাজগুলো করবে।
“তুমিই বাংলাদেশ”- কথাটা বললে হয়ত মনে করবে, এটা কথার কথা বলছি- কেবলই উৎসাহ দেওয়ার জন্য। বিশ্বাস করো, আসলেই আমাদের এই গরিব দেশটার জন্য টানা কয়েকটা ভীষণ উদ্যমী প্রজন্মের প্রয়োজন।
একটা একটা মানুষই পুরো প্রজন্মের অংশ হয়। হয়তো তুমিও সেই ভীষণ প্রয়োজনীয় প্রজন্মের একজন।