নগর পর্যায়ের দারিদ্র্যের জন্য সরকারের করণীয়
এই লেখাটি করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক সমস্যাকে কেন্দ্র করে লেখা। লেখাটি যৌথভাবে লিখেছি আমি ও ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইফপ্রি)’র দক্ষিণ এশিয়া কার্যালয়ের পরিচালক ড. শহীদুর রশিদ। লেখাটি দৈনিক জনকণ্ঠ ও দৈনিক প্রথম আলো-তে প্রকাশিত হয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জাতীয় পর্যায়ের দুর্যোগ নতুন কিছু নয়। রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামরিক অভ্যুত্থান এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য আমাদের দেশকে ভীষণ দুর্দশার চিত্রসহ বৈশ্বিক গণমাধ্যমের শিরোনাম হতে হয়েছে বহুবার। এদেশের জনগণ এবং নেতৃত্ব তাদের দৃঢ়তা এবং সফলতার জন্য ব্যাপকভাবে প্রশংসিতও হয়েছে।কিন্তু কোভিড-১৯ কর্তৃক সৃষ্ট লকডাউন পরিস্থিতি কিছুটা ব্যতিক্রম। দীর্ঘকালীন প্রভাবের কারণে এই অচলাবস্থা নিঃসন্দেহে ১৯৯৮’র বন্যা কিংবা বিভিন্ন সময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতার থেকে সৃষ্টদেশের বিগত অচলাবস্থাগুলোর তুলনায় বৃহৎ।
ন্যাশনাল টেলিকম মনিটরিং সেন্টার জানিয়েছে, ২৬ মার্চ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর ১ কোটি মোবাইল ফোন গ্রাহক ঢাকা ত্যাগ করেছেন। যদি ধরে নেওয়া হয়, এই গ্রাহক সংখ্যার কমপক্ষে ২০% ছিল তাদের ভ্রমণসঙ্গী (যাদের সাথে কোন মোবাইল ফোন ছিল না), তাহলে এইসময়ে ঢাকা ছেড়েছেন কমপক্ষে ১ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ, যা শহরের ঘোষিত মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি! এই সংখ্যা থেকে একটি ঘটনা পরিস্কার: গ্রাম বা ছোট শহর এলাকা থেকে ঢাকায় কাজ করতে আসা প্রায় সকলেই ঢাকা ছেড়েছেন। কারা তাহলে থেকে গিয়েছেন? এর কোন পরিসংখ্যানগত হিসেব নেই- তবে এটি খুবই সম্ভব যে, দরিদ্রদের একটি বড় অংশ শহর ছেড়ে যেতে পারেননি। ভূমিহীন দরিদ্র পরিবারগুলোর পাশাপাশিযে পরিবারগুলো নিজেদের সকল সদস্যের জন্য পরিবহন খরচ যোগাড় করতে পারেননি, তারাও রয়ে গিয়েছেন। যাদের পরেরদিনের খাদ্যসংস্থান হয়নি, তারা শহর ত্যাগ করার কথা ভাবতেও পারেনি। চিত্রটি ভীষণ দুঃখজনক! কিন্তু এর মাধ্যমে একটি সুযোগও এসেছে সরকারের কাছে- নগর পর্যায়ের দরিদ্রদের সুরক্ষার জন্য উদ্ভাবনী কর্মসূচি তৈরি এবং তাদের বৃহৎ উন্নয়ন কৌশলের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার।
উদ্ভাবনী সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির জন্য বাংলাদেশ সুপরিচিত হলেও সেগুলো মূলত গ্রামীণ পর্যায়ের দরিদ্রদের জন্য। নগর পর্যায়ের দরিদ্রদের জন্য এখনও কোন সুরক্ষা কর্মসূচি নেই। কোভিড-১৯ লকডাউন উদ্ভুত পরিস্থিতিতে সরকার বিশেষ কর্মসূচি হিসেবে খোলা বাজারে চাল বিক্রয় শুরু করেছে। এই কর্মসূচির আওতায় ৬ এপ্রিল থেকে ১০ টাকায় প্রতি কেজি চাল বিক্রয় করা শুরু হয়েছিলো, যা মূলত গ্রামীণ দরিদ্রদের জন্য পরিচালিত “খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি”র চালের সমান বিক্রয়মুল্য এবং মোটা চালের বাজারমূল্যের চার ভাগের এক ভাগ। ইতোপূর্বে খোলা বাজারের কর্মসূচিতেই ৩০ টাকা কেজি দরে মোটা চাল বিক্রয় হত। এ বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ ভাষণ থেকে জানা গিয়েছিলো, এই কর্মসূচিতে আগামী তিন মাসে চাল বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৭৪ হাজার টন, যার জন্য সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে প্রায় ২৫১ কোটি টাকা। খুব স্বাভাবিকভাবেই, চালু হওয়ার পরএই কর্মসূচি ব্যাপক চাহিদা তৈরি করে এবং প্রচুর ক্রেতাওএমএস ট্রাকের সামনে ভীড় করা শুরু করে। এই পরিস্থিতিতে সামাজিক দূরত্বের উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়াসহ পদ্ধতিগত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়, যার জন্য সরকার এপ্রিলের ১৩ তারিখ খোলা বাজারে চাল বিক্রয়ের কর্মসূচি স্থগিত ঘোষণা করেন।
বিশেষ ওএমএস কর্মসূচির উদ্দেশ্য যেমন ইতিবাচক ছিল, তা স্থগিতও করা হয়েছে ইতিবাচক উদ্দেশ্যেই। কর্মসূচিটি মহৎ ছিল কারণ এর মূল ক্রেতা ছিল দরিদ্ররা, যারা এই মুহূর্তে আর অন্য কোন উপায়ে খাদ্য ক্রয় করতে পারত না। স্থগিত করার উদ্দেশ্যও মহৎ এই কারণে যে, বাস্তবায়ন-অযোগ্য উপায়ে কর্মসূচিটির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিলো এবং তা ছিল পদ্ধতিগত দিক থেকে বিভিন্ন কারণে অকার্যকর-
প্রথমত, ওএমএস কোন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি নয়, বরং মূল্য স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণের একটি উপায়। এটি বাজারে এক ধরণের সংকেত প্রদান করে এবং একই সাথে ভোক্তা ও ব্যবসায়ীর দূরকল্পী আচরণ (Speculative behavior) কে কিছুটা আয়ত্তে নিয়ে আসে। বড় ধরণের ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে এই ধারণাকে“বিশেষ ওএমএস” লঙ্ঘন করেছে।
দ্বিতীয়ত, এই কার্যক্রমটি পদ্ধতিগত ভাবে বাস্তবায়ন অযোগ্য। যদি বড় ভর্তুকির মাধ্যমে কার্যক্রমটিকে চালানো হত, সরকারের কৌশলগত খাদ্য মজুদ দ্রুত ফুরিয়ে আসার ঝুঁকি থাকতো। সস্তায় চাল ক্রয় করে বেশি দামে বিক্রয় করার মতন ঘটনা বৃদ্ধির আশঙ্কাও রয়ে যেত, অর্থনীতির ভাষায় যাকে বলা হয় Arbitrage।এতে খাদ্য অধিদপ্তরের মজুদে থাকা ১৪ লক্ষ টন খুব শীঘ্রই শেষ হয়ে পড়তে পারত।
তৃতীয়ত, যদি সরকারি খাদ্য মজুদ থেকে কোটা নির্ধারণ করাও হয়ে থাকে, যা জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে বাস্তবায়িত অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে করা হয়েছে, “বিশেষ ওএমএস কর্মসূচি” অতি-উৎসাহী ও মুনাফালোভীদের আকৃষ্ট করার সমূহ সম্ভাবনা আছে।
পৃথিবীজুড়ে এমন অনেক অকার্যকর খাদ্য সুরক্ষা কর্মসূচী টিঁকে আছে কারণ, সেগুলো শক্তিশালী মুনাফালোভী চক্র তৈরি করেছে। “বিশেষ ওএমএস”-এর স্থগিত করার ঘটনা সম্ভবত এই সমস্যাকে এড়িয়ে যেতে পেরেছে। সুতরাং, বিশেষ ওএমএস স্থগিতকরণ একটি ভালো পদক্ষেপ বটে, তবে বিকল্প কোন কর্মসূচি শুরু করতে না পারার ব্যাপারটি ইতিবাচক নয়। লকডাউন পরিস্থিতির প্রায় চার সপ্তাহের মাথায় দরিদ্রদের রক্ষা করা, বিশেষত কোন কর্মসূচির আওতায় না থাকা নগর পর্যায়ের দরিদ্রদের রক্ষা করার দিকে বাড়তি খেয়াল রাখা গুরুত্বপূর্ণ।জীবন রক্ষার জন্য স্বল্পকালীন পরিকল্পনা হিসেবে তাই একটি ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করা যেতে পারে। স্থানীয় প্রশাসন ও সামাজিক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সহযোগিতায় দারিদ্র্যপূর্ণ এলাকায় এই কার্যক্রম চালানো যেতে পারে। আরেকটি স্বল্পকালীন বিকল্প হতে পারে, স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে গণখাদ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা।
যখন করোনার অগ্নিযুদ্ধটি শেষ হয়ে আসবে, সরকারের কাছে বড় সুযোগ থাকবে নগর পর্যায়ের লক্ষ্যগত (Targeted) দারিদ্র্য কর্মসূচিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া। পেছনের যুক্তিটি খুবই পরিস্কার: যদি গ্রামীণ দরিদ্রকে সুরক্ষা করা সামাজিক দায়িত্ব হয়ে থাকে, সেটি নগর পর্যায়ের দরিদ্রদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এই সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যেতে পারে সুবিধাভোগী চিহ্নিতকরণ, তালিকাভুক্তকরণ এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের নিবন্ধনের মাধ্যমে। খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি এইক্ষেত্রে চমৎকার একটি উদাহরণ হয়ে আছে। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইফপ্রি)’র একটি জরিপে দেখা গেছে, হতদরিদ্রদের জন্য পরিচালিত এই কর্মসূচির ৮৫ শতাংশ দরিদ্র এবং এতে তছরুপের (leakage) পরিমাণ প্রায় ১২ শতাংশ, যেখানে ১৯৯০এর দশকে পরিচালিত গ্রাম্য রেশনিং কর্মসূচিতে তছরুপের পরিমাণ ছিল প্রায় ৭০ শতাংশ! খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির পদ্ধতিগত কার্যকারিতার পেছনে তথ্যের ডিজিটাইজেশন ও এনআইডি কার্ডের প্রচলন একটি বড় ভূমিকা রেখেছে। অর্থ, খাদ্য বা পুষ্টির দিক দিয়ে- যেভাবেই সুবিধা দেওয়া হোক না কেন, দরিদ্রদের ডিজিটাল পরিচয় দেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
(মতামত লেখকদের ব্যক্তিগত এবং ইফপ্রি এই মতামতের জন্য দায়বদ্ধ নয়)