অলাভজনক বেসরকারি হস্তক্ষেপে বাড়ুক করোনা টেস্টিং সক্ষমতা
করোনা প্রাদুর্ভাবের সময় টেস্টিং সক্ষমতা নিয়ে এই লেখাটি সারাবাংলা-তে প্রকাশিত হয়
বাংলাদেশে সকল উপজেলা পর্যায়ে সরকারি হাসপাতাল স্থাপন করার বড় কারণ ছিল, রোগীর বাড়ি থেকে হাসপাতাল যাতে কাছে হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসরত রোগীর হঠাৎ কোন সমস্যার সাময়িক অথবা স্থায়ী সমাধানের জন্য সরকারের এই বিনিয়োগ কাজে এসেছে।
শুধু হাসপাতালই নয়, যে কোন মৌলিক সুবিধার বিতরণ ব্যবস্থা যেমন- বিদ্যালয়, খাদ্য বিতরণ কেন্দ্র, বিদ্যুৎ অফিস ইত্যাদি মানুষের বাসস্থানের যত কাছে রাখা হবে, তত বেশি সেই সুবিধার ইতিবাচক ফলাফল পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। সেটা সুবিধা প্রদানকারী এবং সুবিধাভোগী দুইদিক থেকেই প্রযোজ্য। সেবাপ্রাপ্তির স্থানের দূরত্ব বৃদ্ধির সাথে ইতিবাচক ফলাফল প্রাপ্তির এই ঋণাত্মক সম্পর্ক তথ্য বিশ্লেষণভিত্তিক গবেষণা দ্বারাও প্রমাণিত।
এখন করোনার ক্রান্তিকাল, যার প্রাথমিক ধাপ হল রোগীর দেহে করোনা শনাক্তকরণ। কোনভাবে শনাক্তকরণের ধাপে ওলটপালট হলেই শুরু হয় সামাজিক সংক্রমণ, ফলে এলাকা বা দেশভিত্তিক লকডাউন, এরপর জীবিকাজনিত অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে খাদ্যাভাব ও অর্থাভাব। এই কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞ, সোশ্যাল মিডিয়া এক্টিভিস্ট সবাই বলছিলেন, এমনকি এখনও বলছেন, “টেস্ট টেস্ট টেস্ট!” মানে কেবল টেস্ট করো, সনাক্ত করে রোগ প্রশমন ও আরোগ্যকরণের ব্যবস্থা করো।
আমাদের দেশে মার্চের প্রথম দিক থেকে টেস্টের ব্যবস্থা না করতে পারায় বড় সংখ্যক করোনা সংক্রমিত প্রবাসী দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েচিলেন। যার নেতিবাচক প্রভাব এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি। ৩ মে দুপুর পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট সনাক্তের সংখ্যা নয় হাজারের উপরে। সনাক্তকরণ রেখা “ফ্ল্যাটেন” হয়ে আসার তেমন কোন লক্ষণ নেই। কাগজে-কলমের রেকর্ডে আছে ১৭৭ জন মারা যাওয়ার তথ্য।
শুধু ঢাকা শহরে কোভিড-১৯ সনাক্তকরণের হার মোট সনাক্তের ৫৫ শতাংশের কাছাকাছি আর ঢাকা বিভাগীয় পর্যায় হিসেব করলে ৮০ শতাংশের বেশি। তার মানে কি ঢাকা ছাড়া আর কোথাও এমন হটস্পট নেই?
তথ্যবিহীন অবস্থায় এমনটা উপসংহার টানা যায় না। আমরা তথ্যবিহীন- কারণ দীর্ঘদিন শুধু ঢাকায় অবস্থিত আইইডিসিআরের উপর নির্ভর করে টেস্টিং হয়েছে। লেখার শুরুতে যে দূরত্বের সাথে সুবিধাপ্রাপ্তির ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্কের কথা বলেছি, তা এখানে কার্যকর হওয়ার আশংকা তীব্র।
খেয়াল করলে দেখা যাবে, টেস্টিংয়ের বিস্তৃতি ও পরিমাণ বাড়াতে বাড়াতেই অন্যান্য বিভাগগুলোতে সংক্রমণের হার বেড়েই চলেছে। গবেষকরা এর মধ্যে সম্ভাব্য হটস্পট খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন, চলছে কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের কাজ।
ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে বেসরকারি পর্যায়ের ইতিবাচক হস্তক্ষেপ। কন্টাক্ট ট্রেসিং এবং সামাজিক নিরাপত্তা খাতের গবেষণা ও বাস্তবায়ন সহযোগিতায় টেলিকম কোম্পানিগুলো এগিয়ে এসেছে। রবি আর গ্রামীনফোন সরকার এবং গবেষকদের সহযোগিতা করছে বলে জানা গেছে।
মেঘনা গ্রুপ আর সিটি গ্রুপ সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের থেকে কিছুটা কম মূল্যে তাদের উৎপাদিত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে। নিশ্চয়ই এগুলোর সুফল আসা শুরু করবে কিছুদিনের মধ্যে। ব্র্যাক, বিদ্যানন্দ আর পাশে আছি ইনিশিয়েটিভ- এর মতন প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রাউডফান্ডিং এর মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে উদ্ভাবনী পদ্ধতিতে খাদ্য ও অর্থ সাহায্য বিতরণ করছে, যা ক্রান্তিকালের শুরুতে অকল্পনীয় ছিলো। আগাম প্রস্ততির অংশ হিসেবে বসুন্ধরা গ্রুপ দুই হাজার বেডের হাসপাতাল নির্মাণের জায়গা দিয়েছে ও অর্থ প্রদান করেছে।
কিন্তু প্রাথমিক ধাপে এখনও সক্ষমতা অভাব আছে- আমরা যথেষ্ট পরিমাণে এবং যথাসময়ে টেস্ট করতে পারছি না। টেস্টিং কিট ছিল বহুদিনের সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু। এখন কিটের অক্ষমতা সামাল দেওয়ার উপায় পাওয়া যাচ্ছে। তবে ল্যাবের স্বল্পতা ও সক্ষমতার অভাব রীতিমত বেদনাদায়ক!
এপ্রিলের ১৬ তারিখ প্রধানমন্ত্রীর সাথে ভিডিও বৈঠকে নারায়ণগঞ্জের ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন আফসোস করে বলছিলেন, ঢাকায় স্যাম্পল নিয়ে গিয়ে ফলাফল পেতে পেতে অন্তত দুইদিন লেগে যাচ্ছে৷ সম্প্রতি টেলিভিশন প্রতিবেদনে জানা গেছে, পরীক্ষার ফলাফল পেতে ৬-৭ দিন পর্যন্ত লেগে যাচ্ছে।
ফলাফল পাননি কিন্তু সংক্রমিত হয়েছেন- এমন ব্যক্তিকে আইসোলেশন এবং হাসপাতালের সেবাপ্রাপ্তি দিতে দেরি হচ্ছে এবং তারা ভাইরাস বহনকারী হিসেবে সামাজিক সংক্রমণে রাখছেন ভয়ংকর ভূমিকা। দীর্ঘদিন নারায়ণগঞ্জ শহরের ভেতরে পিসিআর ল্যাব না থাকা পুরো শহরজুড়ে সংক্রমণের পেছনে একটা বড় ভূমিকা রেখেছে।
দীর্ঘদিন ধরে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় যে ত্রুটি সৃষ্টি হয়েছে, সেটা নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই৷ ত্রুটিগুলো এই মুহূর্তে সকল ক্ষেত্রে সমাধান সম্ভব নয় অথচ পদক্ষেপ নিতে হবে এই মুহুর্তেই! এই মুহূর্তে তাহলে উপায়টা কী? অবশ্যই বেসরকারি পর্যায়ের বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর অলাভজনক হস্তক্ষেপ!
বেসরকারি উদ্যোগে গত সপ্তাহে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে পিসিআর ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। সরকারি ব্যয় করেও হয়তো এরকম স্থাপনা করা যেত, কিন্তু সেটা যে বিভিন্ন অজানা কারণে সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল হতে পারত, আশংকা থেকে যায়৷ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে ভিডিও কনফারেন্সে যদিও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা বলছিলেন, “রূপগঞ্জে আমাদের একটা ল্যাব হচ্ছে, যেটি গাজী গোলাম দস্তগীর বানাচ্ছেন”। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মন্ত্রী হিসেবে গাজী গোলাম দস্তগীর সাহেব “আমাদের”-ই বটে, তবে এই স্থাপনা হয়েছে গাজী গ্রুপের অর্থের মাধ্যমে৷ নারায়ণগঞ্জের যে ভয়ংকর সংক্রমণ হার, তাতে নিয়ন্ত্রণ আনতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে এই ল্যাব।
তাহলে কি বলতে চাইছি? সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের দ্বন্দ্ব? একদমই না। বরং চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিতে চাই যে, ক্রান্তিকালে সরকারি-বেসরকারি সম্মিলিত উদ্যোগ ভীষণ জরুরি; বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে। বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যারা আরো বড়, তাদের পক্ষে আরো বড় আকারের কর্মসূচি নেওয়া সম্ভব।
নারায়ণগঞ্জে বায়োসেফটি স্ট্যান্ডার্ড নিশ্চিত করা ল্যাবটি স্থাপনে যে টাকা খরচ হয়েছে তা অনেক ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর পক্ষেই প্রদান করা সম্ভব। “রাজনৈতিক জটিলতা না থাকলে” বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর জন্য এই মুহূর্তে সরকারি অনুমোদনসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির কাস্টমস প্রক্রিয়া সম্পাদন কঠিন কিছু নয়। অল্প সময়ে গাজী গ্রুপের পিসিআর ল্যাব তৈরিই তার প্রমাণ।
করোনা পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করেছে৷ তবে তাই বলে তো এখন ভয় পেয়ে টেস্ট থামিয়ে দিলে চলবে না, বরং একে আরো প্রসারিত করতে হবে। তথ্য বিশ্লেষণ সাপেক্ষে দেশের হটস্পট খুঁজে বের করে স্থাপন করতে হবে পিসিআর ল্যাব।
আইইডিসিআরের সর্বশেষ তথ্যমতে, সনাক্তকৃতদের মধ্যে ১৫-৪৪ বছর বয়সী কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর হার প্রায় ৬০ শতাংশ! ব্যবসায়ীরা সাধারণত যে কোন বিনিয়োগের আগে “রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট” বা বিনিয়োগের ফলাফলের কথা চিন্তা করেন। নাগরিক হিসেবে যে বিনিয়োগের অনুরোধ আমরা বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর কাছে করছি, তার রিটার্ন হিসেবে সরাসরি হয়তো অর্থ পাওয়া যাবে না। কিন্তু পাওয়া যাবে জীবন। বাঁচবে দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী। এর থেকে বড় বিনিয়োগ আর কি হতে পারে?