অর্থনীতি বিষয়ে যে ৮টি চলচ্চিত্র দেখে ফেলা উচিত
পলিসি নিয়ে যারা আগ্রহী, তাদের কাছে অর্থনীতির গতিপ্রকৃতির বিশ্লেষণ দেখতে ভালো লাগে। আমিও সেরকম মানুষদের দলে। নিজে অর্থনীতির ছাত্র হওয়ার কারণে হয়তো আগ্রহটা তৈরি হয়েছে। তবে যারা অন্যান্য ডিসিপ্লিনের শিক্ষার্থী, তাদেরও অর্থনীতি নিয়ে নানারকম খোঁজ রাখা লাগে।
অর্থনীতির এই বিশ্লেষণ নিয়মিত পাওয়া যায় পত্রিকার পাতায়, বিশেষজ্ঞদের কলামে আর টেলিভিশন-ইউটিউবে থাকা খবরের বিশ্লেষণধর্মী ভিডিওগুলোতে। এর পাশাপাশি অর্থনীতির ঘটনাপ্রবাহ আর তত্ত্ব বুঝতে সাহায্য করে সুন্দর চিত্রায়ন। আনন্দের সাথে এই চিত্রায়ন দিতে পারে চমৎকার কিছু চলচ্চিত্রও।
এই লেখায় আজকে ৮টি চলচ্চিত্রের কথা বলব, যেগুলো অর্থনীতি সম্পর্কে জানতে আগ্রহীদের চটপট দেখে ফেলা উচিত।
১) আ বিউটিফুল মাইন্ড (২০০১)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ক্লাস নেওয়ার সময় আশিক স্যার (প্রফেসর আশিকুজ্জামান) এই চলচ্চিত্রের উদাহরণ দিতেন মাঝে মাঝেই।
অনেকেই হয়তো এই চলচ্চিত্রের নাম জানেন, কেউ কেউ হয়তো দেখেও ফেলেছেন। চলচ্চিত্রটি নেওয়া হয়েছে সিলভিয়া নাসারের একই নামের সাড়াজাগানো বই থেকে। রন হাওয়ার্ডের পরিচালনায় হওয়া এই চলচ্চিত্রের মূল চরিত্র জন ন্যাশ, যিনি মূলত একজন গণিতবিদ। এই চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন রাসেল ক্রো। গেইম থিওরির ন্যাশ ইকুইলিব্রিয়ামের ন্যাশ কে জানতে চমৎকার এই মুভিটি দেখে ফেলতে পারেন।
জেনে রাখা ভালো, একদিকে বাস্তবিক জীবনে এই জন ন্যাশ তার গেইম থিওরির কাজের জন্য পেয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার, অন্যদিকে তাকে নিয়ে তৈরি হওয়া এই চলচ্চিত্রটিও পেয়েছিলো ৪ (চার) টি একাডেমি এ্যাওয়ার্ড।
২) দ্য উলফ অব ওয়াল স্ট্রিট (২০১৩)
ওয়াল স্ট্রিটের অর্থনীতির দিকে পৃথিবীজুড়ে বহু লোককে তাকিয়ে থাকতে হয়। বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের শেয়ারের কেনাবেচার জায়গা এই ওয়াল স্ট্রিট আসলে কেমন জায়গা? ওয়াল স্ট্রিটের বিনিয়োগকারী আর শেয়ার ব্রোকারদের উন্মাতাল বিলাসী জীবনযাপন আর তাদের কার্যক্রমের একটা ধারণা দিতে পারে এই চলচ্চিত্রটি। যেখানে শেয়ার মার্কেট ওয়াল স্ট্রিটের মতন জায়গায়, সেখানে কোন কারসাজি বা স্ক্যাম হলে আসলে কি হয়?
পুরো চলচ্চিত্রটিকে মাতিয়ে রেখেছিলেন ব্রোকার চরিত্রে অভিনয় করা লিওনার্দো দ্য ক্যাপ্রিও। তার হাতে পরবর্তী বছর অস্কার আসার আগে স্বাভাবিকভাবেই কথা উঠেছিলো, দ্য উলফ অব দ্য ওয়াল স্ট্রিট ছবির অভিনয়ের জন্য তিনি অস্কার পাবেন কিনা!
৩) মার্জিন কল (২০১১)
২০০৭-০৮ এর অর্থনৈতিক মন্দার কারণ আর ফলাফল সম্পর্কে পুরোপুরি না জানলে আধুনিক অর্থনীতির শিক্ষার্থী হওয়ার মজাটা কোথায়? হাহা, বলতে যতটা ‘মজা’ লাগছে, অর্থনৈতিক মন্দা ততটা মজার কিছু যে ছিল না, সেটা তো অনেকেই জানি। লাখ লাখ কর্মীর ছাটাই, একের পর এক দেশে অর্থনীতি ধ্বসে পড়া সহ বিভিন্ন ঘটনার সাক্ষী এই অর্থনৈতিক মন্দা। এই সময়টার শুরুর দিক নিয়েই জে সি চ্যান্ডর পরিচালিত “মার্জিন কল” ছবিটি বানানো হয়েছে।
একটি বিনিয়োগ ব্যাংকের একজন কর্মী তার VAR (ভেক্টর অটো রিগ্রেসিভ) মডেল এস্টিমেশন দিয়ে কিভাবে আসন্ন বিপদ আঁচ করেছিলেন, সেটি নিয়ে এই চলচ্চিত্রটি। অর্থনীতি, ইকোনমেট্রিক্স আর প্রোগ্রামিং কিভাবে অনেক বিপদের সংকেত দেখিয়ে দিতে পারে, সেটি জানতে দেখা যেতে পারে এই চলচ্চিত্রটি। আপনি যদি উৎসুক হয়ে থাকেন, “কি হবে এত স্ট্যাটা-প্রোগ্রামিং আর ইকোনমেট্রিক্স জেনে”- তাহলে এই চলচ্চিত্রটি আপনাকে কিছুটা হলেও উত্তর দিতে পারে।
৪) দ্য পারস্যুট অব হ্যাপিনেস (২০০৬)
বাস্তব ঘটনার উপর ভিত্তি করে বানানো এই চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে মার্কিন উদ্যোক্তা আর খ্যাতনামা বক্তা ক্রিস গার্ডনারের অর্থনৈতিক জীবনের শুরুর দিকের সংগ্রামকে বিবেচনায় রেখে। মূল চরিত্রে উইল স্মিথ আর তাঁর ছেলে জ্যাডেন স্মিথের দুর্দান্ত চরিত্রায়ন আপনাকে কাঁদিয়েও ফেলতে পারে সময়ে সময়ে।
দারুণ সব সংলাপ, পারিবারিক অভাবের চিত্র, ব্রোকারেজ হাউজের বাস্তবতা এই চলচ্চিত্রকে করেছে আই এম ডি বি বিশ্বসেরা ২০০ চলচ্চিত্রের একটি। উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন যারা দেখেন, তাদের জন্য এটি হতে পারে অনেক শিক্ষনীয়। কিভাবে গার্ডনার তার মাল্টিমিলিয়ন ডলার ব্রোকারেজ হাউজ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, সেটি জানার জন্য এই মুভিটি দুর্দান্ত।
৫) দ্য ইনসাইড জব (২০১০)
এই ডকুমেন্টারি ফিল্মটিও ২০০৮ এর অর্থনৈতিক মন্দার সময়কে নিয়ে। দুর্নীতি, ব্যাংকগুলোর মুনাফালোভী কার্যক্রম আর নীতিনির্ধারকদের ভুল কিভাবে দেশকে টালমাটাল করে দিতে পারে, তার চিত্রায়ন এসেছে এই ফিল্মে।
এই মন্দা পরবর্তীতে ২০ ট্রিলিয়ন ডলারের ক্ষতির কারণ হয় আর লাখ লাখ মানুষ তাদের কর্মসংস্থান হারায়। অর্থনৈতিক মন্দার সময়কালের বিস্তারিত অল্প সময়ে জানতে চাইলে এই চলচ্চিত্রটি দেখা যেতে পারে অনায়াসেই।
৬) ক্যাপিটালিজম আ লাভ স্টোরি (২০০৯)
মাইকেল মুরের দারুণ উপস্থাপনায় এই ডকুমেন্টারি ফিল্মটি আপনার চোখ খুলে দিতে পারে অর্থনৈতিক দুনিয়ার অনেক না জানা কথা সম্পর্কে। যদিও এখানে মুরের নিজস্ব রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রাধান্য পেয়েছে, তবুও উপস্থাপিত তথ্য আর ঘটনাগুলো অসত্য নয়।
গোল্ডম্যান স্যাকস বা মেরিল লিঞ্চের মতন সুবিশাল কর্পোরেশন গুলোর দোর্দন্ড প্রতাপে কিভাবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আর মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রিত হয়, সেটির চিত্রায়ন প্রমাণসহ এত চমৎকারভাবে নিয়ে আসা হয়েছে, না-জানা অনেকেরই চোয়াল নেমে যেতে পারে। রোনাল্ড রিগ্যানের সময়কার অনেক বিতর্কিত অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত (যেগুলো ‘রিগ্যানোমিক্স’ নামে পরিচিত) গুলো সম্পর্কেও এক ঝলকে ধারণা হয়ে যেতে পারে আপনার।
৭) দ্য বিগ শর্ট (২০১৫)
অর্থনৈতিক মন্দা নিয়ে এত চমৎকার সব চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে যে এটির নামও উল্লেখ না করে পারছি না। ব্যাটম্যান-খ্যাত ক্রিশ্চিয়ান বেল, রায়ান জসলিং সহ তারকাসমৃদ্ধ এই চলচ্চিত্রে কি দারুণ চিত্রনাট্য বানানো হয়েছে, তা না দেখলে বোঝা যাবে না। মাইকেল লুই-এর লেখা বিখ্যাত একটি বইয়ের উপর নির্ভর করে বানানো এই চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে কিভাবে ২০০৮ এর হাউজিং বাবল তৈরি হয়েছিলো।
হাসতে হাসতে টাকা বানিয়ে বড়লোক বনে যাওয়া, অন্যদিকে কোটি মানুষের টাকা হারানোর সময়টা সম্পর্কে অনেকেই ধারণা করতে পারছিলেন বলে দাবি করা হয়। কিন্তু তাদের কথা সময় অনুযায়ী শোনা হয় নি। উচ্চ-ঝুঁকির সাবপ্রাইম লোনের ধারণাসহ বিভিন্ন টার্মিনোলজির সাথেও পরিচিত হয়ে যেতে পারেন এই চলচ্চিত্রটি দেখে। এই চলচ্চিত্রটি সেরা চিত্রনাট্যের জন্য একাডেমি এ্যাওয়ার্ড-ও জিতে নিয়েছিল।
৮) মানি-বল (২০১১)
ব্র্যাড পিট আর জোনাহ-হিল অভিনীত এই চলচ্চিত্রটিও একটি সত্য কাহিনী অবলম্বনে তৈরি হয়েছে। ডাটা সায়েন্স নিয়ে যারা আগ্রহী,তাদের জন্য এই চলচ্চিত্রটি চোখ খুলে দেওয়ার মতন হতে পারে। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়া একজন তরুণ অর্থনীতিবিদের শুধু ডাটা এ্যানালিসিসের উপর ভিত্তি করে বানানো একটি বেসবল টিম কি দুর্দান্ত পারফর্মেন্স করতে পারে, সেটিই তুলে আনা হয়েছে এই চলচ্চিত্রে।
বলে রাখা ভালো, ডাটা সায়েন্স কিন্তু বর্তমানের মানি-মেশিন সায়েন্স! বর্তমান বিশ্বে যে কয়টি পেশা সব থেকে বেশি সম্মানী পায়, তার মধ্যে শুরুর দিকে আছে এই ডাটা সায়েন্টিস্টদের পেশা।
আমার দৃষ্টিতে এগুলোই ছিলো অর্থনীতি নিয়ে সেরা ৮ চলচ্চিত্র! অর্থনীতি বিষয়ে আপনার দেখা অন্য কোন চলচ্চিত্রের কথা জানিয়ে দিতে পারেন কমেন্টে!