তরুণদের কর্মসংস্থানে বৈচিত্র্য, স্বপ্নপূরণের আকাঙ্খায়
লেখাটি ছাপা হয়েছিলো নিউজ পোর্টাল সারাবাংলায়। পড়তে পারেন এই লিংকে গিয়েও।
সরকারি চাকরিতে তরুণদের উৎসাহ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কোনটিরই কমতি নেই। এই চাকরির উদ্দেশ্যে ছুটছেন বহু তরুণ। সরকারি চাকরি না পাওয়ার হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে আত্মহত্যার নজির পর্যন্ত তৈরি হয়েছে। দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট ঠিক কোন অবস্থানে থাকলে এরূপ হতাশার মাত্রা এত বেশি হয়, সেটা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে।
মেধাবি তরুণেরা সরকারি চাকরিতে গেলে দেশের মঙ্গল- এই বিবৃতিতে বিশেষ কোন আপত্তি নেই।যারা গঠনমূলক উপায়ে আপত্তি করেন, তাদের মূল বক্তব্য, ভবিষ্যতের অর্থনীতি চলবে যে তরুণ জনসম্পদ দিয়ে, সেই জনসম্পদের বন্টন যদি সঠিক উপায়ে এবং সঠিক সময়ে না হয়, তাহলে আফসোসের কমতি থাকবে না।
সরকারি চাকরির বেতন বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির ঝুঁকি আছে, সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে গেলে সেই ঝুঁকি অনেকটা কম। বয়োজ্যেষ্ঠ্যরা সরকারি চাকুরির সামাজিক মর্যাদার কথাও বলে থাকেন। কিন্তু সরকারি আমলা হয়ে যে মর্যাদা অর্জন সম্ভব, সেই মর্যাদা কেন শিক্ষক, গবেষক, ভালো কর্পোরেট কর্মকর্তা হয়ে পাওয়া যাবে না? আবার, সরকারি চাকুরে হলে নাগরিক সেবা নেয়ার ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা সম্ভব বলে একটা ধারণা রয়েছে। নিশ্চয়ই আমাদের নাগরিক সেবা ব্যবস্থাপনায় এমন কোন সমস্যা হচ্ছে, যেগুলো তরুণদের এমন বিশ্বাস তৈরি করছে। এর প্রতিকারে নাগরিকদের মধ্যে সেবাপ্রাপ্তিতে সমতা বিধান নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার দায়িত্ব সরকারেরই।
সরকারি চাকরির আকাঙ্ক্ষা কোন নেতিবাচক বিষয় নয়। কিন্তু সমানভাবে বেসরকারিখাত, গবেষণাখাত সহ অন্যান্য খাতে চাকরির আগ্রহ বাড়ছে না কেন, সেটা নিশ্চিতভাবেই খতিয়ে দেখার মতন বিষয়। প্রথমত, দেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে উপযুক্ত কাজের সুযোগের অভাব তৈরি হচ্ছে। একদল তরুণ আছেন- যারা যোগ্যতা অনুযায়ী আকাঙ্ক্ষিত চাকরি পাচ্ছেন না। উপরন্তু, চাহিদা-যোগানের স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী, যেহেতু শ্রমের যোগান অনেক বেশি এবং চাহিদা তুলনামূলকভাবে কম, প্রাপ্ত শ্রমের দাম কমিয়ে দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলস্বরূপ, অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেই পারিশ্রমিকের পরিমাণ সন্তোষজনক থাকছে না।
দ্বিতীয় কারণের মধ্যে রয়েছে, দক্ষতায় অসামঞ্জস্য। অর্থাৎ তরুণ চাকরিপ্রার্থী হয়ে আমরা বুঝতে পারছি না যে, চাকরির বাজারে বিরাজমান প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রাসঙ্গিক হতে গেলে কোন কোন দক্ষতা আমাদের প্রয়োজন। এই অবস্থার জন্য চাকরিপ্রার্থীদের নিজেদের দায় রয়েছে। সময়ের সাথে তাল মেলানো কম্পিউটার দক্ষতা, ইংরেজিতে ভালো লেখনী ও মৌখিক উপস্থাপনার যোগ্যতা ছাড়াও এখন প্রতিষ্ঠানভেদে ভিনদেশী ভাষায় দক্ষতা বা বিশেষায়িত সফটওয়্যারে পারদর্শিতাসহ কিছু ব্যবহারিক যোগ্যতার প্রয়োজন হয়, যার প্রস্তুতি সামগ্রিকভাবে আমাদের পাঠ্যক্রমে অনেকটাই অনুপস্থিত এবং তরুণরাও তা গ্রহনে কম আগ্রহী।
সমস্যা সমাধানে পঠিত বিষয়ের সাথে প্রাসঙ্গিক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাজীবনেই ইন্টার্নশিপ বা প্রশিক্ষণের সুযোগ খুঁজতে হবে। নিজের পাঠ্যক্রমে প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার শেখানো না হলে অনলাইনের মাধ্যমে সেই প্রশিক্ষণ নিতে হবে। বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে ভারতীয়দের পাওয়া রেমিট্যান্সের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি, যা তাদের রেমিট্যান্স উৎসের দিক থেকে পঞ্চম! দেশে বিশেষ দক্ষতার শ্রমিক না থাকার একটা বড় কারণ, কারিগরি শিক্ষার প্রসার না ঘটা। এ বিষয়ে সরকারের নেয়া কর্মসূচিতে ভালো চাকরির সম্ভাবনা এবং সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ সত্ত্বেও কারিগরি শিক্ষাকে এখনো যথাযথ বিজ্ঞাপনের সাথে প্রচার করতে পারি নি আমরা।
ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে অনার্স, মাস্টার্স ডিগ্রী নিতে শহর থেকে গ্রামের সম্ভাবনাময় তরুণেরা রাজি, কিন্তু সম্ভাবনাময় কারিগরি খাতে যেতে রাজি নন। উন্নয়ন অর্থনীতির তাত্ত্বিক দিক থেকেও উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোতে এই বিপুল সংখ্যক অতিরিক্ত স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীকে দেশের জন্য অলাভজনক বলা হয়ে থাকে। কারণ, একই ধরণের উচ্চশিক্ষিতদের থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রাপ্তির ক্ষেত্র হয়ে যেতে পারে সীমিত। শিল্পখাতে এখনো বিকাশমান এই দেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হলে তৈরি হতে পারে অনেক সুযোগ। সেখানেও কিছু সমস্যা রয়েছে, যা নিয়ে এখনই আলোচনা করছি।
তৃতীয় কারণ- বিগত বেশ কয়েক বছরে বিনিয়োগের পরিবেশ, রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে আশানুরূপ বেসরকারি বিনিয়োগ হয়নি। ছোট এই অর্থনীতির দেশের জিডিপির ২৯ শতাংশ বিনিয়োগের এবং বেসরকারি বিনিয়োগ এখনো ২৩ শতাংশের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে যা এখনো আশানুরূপ নয়।পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এই বিনিয়োগ-জিডিপির অনুপাত ৩০ শতাংশের বেশি, মায়ানমারে প্রায় ৩৪-৩৫ শতাংশ এবং শ্রীলংকায় প্রায় ৩১ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের ব্যবসায়িক পরিবেশ বিবেচনায় বিশ্বের ১৯০ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৭। অথচ দেশে দৃষ্টান্ত রয়েছে, আন্তর্জাতিক বড় বড় প্রতিষ্ঠান দেশে আসলে নতুন কর্মসংস্থান এর পাশাপাশি নতুন জ্ঞান ও প্রযুক্তির আগমন (নোলেজ এ্যান্ড টেকনোলজি ট্রান্সফার) ঘটেছে। দেশে ব্যবসা করতে আসা বিদেশি প্রতিষ্ঠানে এখন শীর্ষ কর্মকর্তাও হচ্ছেন বাংলাদেশিরা।
চতুর্থ কারণ হিসেবে রয়েছে, ব্যক্তি উদ্যোগকে প্রণোদনা দেওয়ার অভাব। রাষ্ট্র ও সামাজিক বাধা - দুটিই এজন্য দায়ী। বাজেটে প্রতিবার ব্যক্তিখাত অবহেলিত হয়।এক্ষেত্রে, পারিপার্শ্বিক সহযোগিতা পেলে কিরকম বদল হতে পারে, তার চমৎকার উদাহরণ, রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় ক্ষুদ্র পুঁজির তরুণদের সাম্প্রতিক আশাতীত সাফল্য। সরকার চাইলে তরুণ উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে নতুন অনেক শিল্পের উত্থান ঘটতে পারে।
পঞ্চম কারণ, রপ্তানির বৈচিত্র্যহীনতা, যা নতুন কর্মক্ষেত্রে তৈরি হতে দিচ্ছে না। অর্থনীতির গবেষক মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক তাঁর সাম্প্রতিক এক প্রকল্প গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, বাংলাদেশের মাত্র ২০টি পণ্য থেকেই রপ্তানি আয়ের ৭০ শতাংশ আসে। নতুন রপ্তানি খাতগুলো উৎসাহ না পাওয়ায় রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে তাদের অবদানও মাত্র ৭-৮ শতাংশ।
ষষ্ঠ কারণটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। মেধাবি বহু শিক্ষার্থী এখন গবেষণা আর শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে প্রাধান্য দিতে চান না। সম্মিলিত এই খাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য ৬৬৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকার বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে। বাজেটে গবেষণা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র ১৪ কোটি টাকা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সেটা আরো চোখ কপালে তুলে দেয়ার মতন- মাত্র ৭৫ লক্ষ টাকা, যা তাদের মোট বাজেটের ০.৩২ শতাংশ!
দেশের জিডিপির মোট বরাদ্দের মাত্র ২.১ শতাংশ বরাদ্দ রয়েছে শিক্ষা ও গবেষণায়।পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মৌলিক গবেষণা করার টাকা নেই। ৯৬ টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগই মৌলিক বিষয় বাদ দিয়ে উদ্বৃত্ত শ্রমিক উৎপাদনে ব্যস্ত। শিক্ষাখাতে বরাদ্দের দিক দিয়ে আমরা বিশ্বের ১৬১ টি দেশের মধ্যে ১৫৫ তম। প্রণোদনা বা ইনসেনটিভ যেখানে কম, সেখানে গবেষণা করে কি হবে, এই ভেবে অনেক সম্ভাবনাময় তরুণ তাই গবেষণায় আগ্রহ হারাচ্ছেন। আশার কথা, বিজ্ঞানের মূলধারা এবং সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় নিজ উদ্যোগে তহবিল এনে অনেক গবেষক ইতিবাচক গবেষণা করছেন। কিন্তু এভাবে মৌলিক গবেষণাকে এগিয়ে নেওয়া কতটা সম্ভব! গবেষক হওয়ার প্রত্যাশায় অনেক তরুণ তাই বিদেশে চলে যাচ্ছেন। এরূপ ‘ব্রেইন ড্রেইন’ কে কতটা দোষারোপ করা যায়?
জনমিতি লভ্যাংশ কাজে লাগানোর যে স্বপ্ন আমাদের রয়েছে, তাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে সবগুলো দিক থেকে তরুণদের বিকাশের সুযোগ করে দিতে হবে। সেটা ব্যবসা হোক, চাকরি হোক, গবেষণা বা শিক্ষকতা হোক। শুধু একদিকে সবাই ছুটলে যে জনসম্পদের বড় অপচয় হয়ে যাবে!