গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষদের নিয়ে এক গবেষণার গল্প
নোবেলজয়ী দুই অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ ব্যানার্জি ও এস্থার ডুফ্লো তাদের সদ্য প্রকাশিত বই “গুড ইকোনমিকস ফর হার্ড টাইমস”-এ বাংলাদেশী দুই অর্থনীতিবিদের একটা গবেষণা নিয়ে আলোচনা করেছেন, বেশ বিস্তারিতভাবে। সেই গবেষণার গল্পটাই বলি।
২০১৪ সালে বাংলাদেশের দুই অর্থনীতিবিদ একটি কাজ একাডেমিক এলাকায় বেশ আলোড়ন তুলে। বর্তমানে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মুশফিক মোবারক আর সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক শ্যামল চৌধুরীর সাথে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের প্রভাষক ব্রায়ানের এই কাজটি অর্থনীতির শীর্ষ জার্নাল ইকোনমেট্রিকায় প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে।
সাধারণভাবে মানুষ নিজের গ্রামের আরামপ্রিয় বাসা বদলাতে চায় না। এমনকি অল্প কিছু দূরের শহরে কাজের সুযোগ বেশি থাকলেও।
উত্তরাঞ্চলের মংগার সময়ে অবস্থা আরও করুণ থাকে। (এখন মংগার দুর্বিষহতা অনেকখানি কমেছে, আগে আরও বেশি ছিল)। গবেষকেরা স্থানীয় এনজিও’র মাধ্যমে সেখানে র্যান্ডমাইজড কন্ট্রোল ট্রায়াল পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। একটা দল কে শুধু শহরের কাজের সন্ধানের জায়গা আর তথ্য জানানো হয়। আরেক দলকে এই তথ্যগুলোর সাথে দেওয়া হয় ১১.৫০ ডলার (৮৫০ টাকার মতন), যাতে তারা বাসে করে কাজ খুঁজতে যায়, শর্ত একটাই- কাজ খুঁজতে যেতে হবে।
যাদের শুধু তথ্য দেওয়া হয়, তারা কাজের সন্ধানে শহরে যায়নি।যাদের শর্তসাপেক্ষে টাকা দেওয়া হয়েছিল, তারা গিয়েছে এবং কাজ খুঁজেছে। এভাবে পুরো গবেষণার স্যাম্পলের ২২ শতাংশ অভিবাসনে গিয়েছিল। গবেষণার ফলাফলে দেখানো হয়, কিছু প্রণোদনা আর কাজ সম্পর্কিত তথ্য দেওয়ার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ অভিবাসন বা ইন্টারনাল মাইগ্রেশন ঘটলে গড়ে প্রায় ৫০ শতাংশ ক্যালরি গ্রহন বাড়তে পারে।
এই ফাইন্ডিং রীতিমত আলোচনা আর একাডেমিক বিতর্কের ঝড় তোলে! বাস টিকেটের টাকা দিয়ে আচরণের পরিবর্তন? এটাও সম্ভব? গবেষকেরা মানুষের আচরণগত অর্থনীতির এই বিচিত্র দিকটাই দেখাতে চেয়েছেন। একটা Nudge বা ধাক্কা প্রয়োজন।
এই একই গবেষণা আরও অনেক বড় আকারে আবার চালানো হয় একই গবেষকদের মাধ্যমে।
আচরণগত দিকের নতুন গবেষণায় আরও ইন্টারেস্টিং ফাইন্ডিং হল, বেশ কিছুদিন যাওয়ার পরে বেশি টাকা আয় আর খাওয়ার সুযোগ পাওয়ার পরেও অনেকে শহর পরিবর্তনের কাজ করতে চায় নি। মানে, দীর্ঘমেয়াদে এই পদ্ধতি কাজ করার সম্ভাবনা কম। কারণ কী? হতে পারে, অপরিচিত জায়গায় যেতে চাওয়ার ব্যাপারে অনীহা কিংবা পরিবারের বন্ধন ছেড়ে বাইরে যেতে না চাওয়া।
আরসিটি'র সমালোচকেরা বলেন, বড় আকারে এই ধরণের পরীক্ষা নিরীক্ষা করলে সফল না হওয়ারই কথা। একে বলা হয় “এক্সটারনাল ভ্যালিডিটি প্রবলেম।”
প্রশ্ন থাকে, কিরকম “ধাক্কা” দিলে মানুষ আরেকটু বেশি আয়ের কাজ খুঁজবে?
নিজের পরিবারের খাদ্যচাহিদা পূরণে আরেকটু সচেষ্ট হবে না এরা?
কি কি কারণে মানুষ চায় না আরও ভালো জীবনযাপন করতে?
মাইগ্রেশন বা অভিবাসন বিষয়ক অর্থনীতির নানামুখী আলোচনা আছে। কেউ মনে করেন এরকম অভিবাসন দরকার নেই, কেউ বলেন দরকার আছে। কেউ বলেন, মানুষের আত্মবিশ্বাস কম থাকার কারণে ইচ্ছাকৃত অভিবাসন করতে চায়না। কিছুদিন আগে প্রভাবশালী ম্যাগাজিন “দ্য ইকোনমিস্ট” বাংলাদেশের এই গবেষণার কথা তুলে এনেছে তাদের একটি প্রতিবেদনেও। তবে তারা কয়েক কাঠি এগিয়ে উপসংহার টেনেছে। নিজেদের হিস্টোরিক্যাল অবজার্ভেশন আর কয়েকটি গবেষণা পত্রকে সামনে এনে তারা প্রমাণ করতে চেয়েছে, মহাত্মা গান্ধী যে গ্রামকে মহান বলতে চেয়েছেন, সেটা আসলে রদ্দি ব্যাপার! মুশফিক মোবারক-শ্যামল চৌধুরীর আর্টিকেলটি যদিও সেটা বলেনি একদমই!
“গ্রাম হবে শহর” এই দিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছিলো বাংলাদেশের বর্তমান সরকারি দল। তবে সংবেদনশীলতা বেশি হওয়ায় ইদানিং সেই কথা খুব বেশি বলতে শুনছি না।
কি অদ্ভুত কথা! গ্রাম থাকবে না নাকি তাহলে?
সামাজিক বিজ্ঞানের গবেষণার সৌন্দর্য-ই এটা। উত্তর আর দৃষ্টিভঙ্গি হতে পারে অনেক!