রাজনৈতিক বার্তা বনাম বাস্তবতা
“নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু” কথাটা দারুণ একটা বিজ্ঞাপন। একটা প্রকল্পকে “স্বতন্ত্র একটা প্রতিষ্ঠান” হিসেবে চিন্তা করলে কথা সত্য। তবে সত্য ব্যাপারটা হচ্ছে, এই প্রকল্পের ম্যানেজারিয়াল প্রতিষ্ঠানটার নাম সরকার, যার অধীনে পদ্মাসেতু একটি মেগা প্রকল্প। সরকারের এমন আরও অনেক মেগাপ্রকল্প/প্রকল্প আছে, যেগুলো সরকারকে অর্থায়ন করতে হয়, চালাতে হয়।
যে দেশের জিডিপির ৩৪ শতাংশ ঋণের উপর নির্ভরশীল, খুব স্বাভাবিকভাবেই, সেই দেশের হাতে পুরো দেশের সব প্রকল্পকে আত্মনির্ভরশীল করার সুযোগ নেই। কাজেই একটা প্রকল্পকে “নিজেদের টাকায়”, মানে, রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে দেওয়ার অর্থ হল, অন্য প্রকল্পের অর্থায়নের ক্ষেত্রে ঋণের পরিমাণ বাড়াতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক ব্যালেন্স শিট এভাবেই তৈরি করার কারণ, আমাদের কোষাগারের অর্থ সীমিত।
পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রেও ঘটনাটা তাই।
বিশ্বব্যাংক আমাদের দীর্ঘদিনের উন্নয়ন-সহযোগী। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে তাদের ভূমিকায় আমাদের উপকার-অপকার হওয়ার আলোচনা থাকতে পারে, তবে সামগ্রিকভাবে তাদের প্রয়োজনীয়তার কথা অস্বীকার করা যাবে না। পদ্মা সেতুর যখন ৪১তম স্প্যান বসছে (ডিসেম্বর ১০, ২০২০), তখন বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাংলাদেশে ৮১টি প্রকল্প চলমান (তথ্যসূত্রঃ বিশ্বব্যাংক ওয়েবসাইট), যেখানে কোথাও বিশ্বব্যাংক ১০০% অর্থায়ন করেছে, কোথাও সরকার ও অন্য প্রতিষ্ঠানের সাথে অংশীদারীত্বের ভিত্তিতে বিনিয়োগ করেছে। মহামারীর সময়ে আমরা বিশ্বব্যাংকের কাছে “হাত পেতেছি” ভ্যাক্সিন কেনার টাকার আশায়। তাদের কাছে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলারের মত ঋণসাহায্য চেয়েছি আমরা। এই মুহুর্তে এটায় লজ্জা পাওয়ার কিছু নাই। আমরা দরিদ্র দেশ। স্বাভাবিক সময়েই সবকিছু সামলে উঠতে পারি না। আর মহামারী তো আমাদের জন্য অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সময়। এই সময়ে সাহায্য চাওয়ারই কথা।
কেন বিশ্বব্যাংকের কথা বললাম? কারণ “বিশ্বব্যাংকের মত প্রতিষ্ঠানের বিরূদ্ধে এটা আমাদের বিজয়” নামে একটা অদ্ভুত ন্যারেটিভ তৈরির চেষ্টা চলছে, সেটা জেনে-না জেনে যেভাবেই হোক। কানাডায় দুর্নীতি-বিষয়ক মামলায় আমরা জিতেছিলাম। সেটা মেনে বিশ্বব্যাংক এই প্রকল্পেই অর্থায়ন করতে চেয়েছিল, কিন্তু আমরা সেটা করতে দেইনি। কারণটা অবশ্যই শিরোনামের এই রাজনৈতিক বার্তা।
সামগ্রিকভাবে কি এটাকে বিজয় বলা যেতে পারে?
জেনে রাখা ভালো, বিশ্বব্যাংকের সেই সময়ের বরাদ্দকৃত টাকা কিন্তু এই দেশ থেকে চলে যায়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে আর দৃঢ়তার সাথে ওই ঋণ প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন শুধু পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে। কিন্তু বিশ্বব্যাংক তো বাংলাদেশের জন্যই সেই টাকা রেখেছে। অর্থনীতির আকার বা জিডিপি বড় করতে চাওয়া সরকারের জন্য এত বড় ঋণের অর্থ চলে যেতে দেওয়া বোকামি। যারা জিডিপির ক্যালকুলেশন বোঝেন, তারা হয়তো জানেন, জিডিপি'র একটা বড় কম্পোনেন্ট বা উপাদান হল সরকারি ব্যয়।
তাই, উপরে যেমনটা বললাম, ভিন্ন প্রয়োজনীয় প্রকল্পসমূহে এই ঋণের টাকা ডাইভার্ট করা হয়েছে। তাতে “নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু” হলেও অন্য প্রকল্পগুলোতে বিশ্বব্যাংকের ঋণের রেশিও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বা কখনও হয়তো নতুন প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। যেমন, খাদ্য মন্ত্রণালয় তাদের একটা মেগা প্রকল্পের জন্য এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে। এভাবে আরও অনেক প্রকল্পকেই অর্থ দেওয়া হয়েছে।
মানেটা কি দাঁড়ালো? সরকার একটা ম্যানেজারিয়াল প্রতিষ্ঠান হিসেবে অর্থ বরাদ্দের চ্যানেল বদল করেছে। পদ্মা সেতুর টাকা পেয়েছে অন্য কোন প্রকল্প। অন্তত এই ম্যানেজমেন্টে অন্যায় কিছু নাই। ম্যানেজার এটা করতেই পারে। এই প্রক্রিয়ায় কাজ করে সরকার তাদের এই “নিজস্ব অর্থায়ন” বিষয়ক বার্তায় রাজনৈতিকভাবে অনেকটাই বিজয়ী বলা যায়। দেশব্যাপী একটা ন্যারেটিভও তৈরি করে ফেলা গেছে।
তবে আমরা যারা এই ন্যারেটিভে উৎসাহিত, তাদের এটাও মনে রাখা উচিত, পদ্মার রেল প্রকল্পের জন্য চীনের এক্সিম ব্যাংকের কাছ থেকে প্রায় ২৬৭+ কোটি ডলার ঋণ (প্রায় ২৪০০০+ কোটি টাকা) নেয়া হয়েছে বিশ্বব্যাংকের থেকে অধিকতর সুদের হারে। এই রেলপথ নির্মাণের জন্য চীনের একটা ফ্যাক্টরি বসানো হয়েছে সেতুর কাছেই, যেখানে রেললাইনের কয়েক লক্ষ স্লিপার তৈরি করবে। অভ্যন্তরীণ ব্যাংক থেকেও যে ঋণ নেওয়া হবে, তার সুদের হারও বেশি। সবই পরিশোধ করতে হবে রাষ্ট্রীয় খাত থেকে।
নিঃসন্দেহে পদ্মা সেতু উপকারি একটি প্রকল্প৷ দক্ষিণের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে এই সেতু ভূমিকা রাখবে, এটাই আশা। মানুষের কর্মসংস্থান হোক,পেশাজীবি শিক্ষার্থীদের যাতায়াত সুবিধা বাড়ুক। জিডিপি বৃদ্ধির যে প্রাক্কলন দেখানো হয়েছে (অন্তত ১.২ শতাংশ) একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে, সেটা যেন আমাদের সামগ্রিক ব্যয়কে ছাড়িয়ে যায়।
আর যেটা রাজনৈতিক বার্তা– " নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বানালাম”, সেটা রাজনৈতিকই থাকুক। আক্ষরিক অর্থে কথাটায় ভুল না থাকলেও এখান থেকে আপনি নিজেকে এখনই আত্মনির্ভরশীল ভেবে বসলে ভুল করবেন। অন্তত যারা পলিসি নিয়ে পড়াশুনা করেন, অর্থনীতি আর উন্নয়নের পরিকল্পনা নিয়ে ভাবেন, তারাও এই বার্তায় বুঁদ হয়ে থাকবেন না।
জীবনের জন্য আবেগ প্রয়োজনীয়, পলিসির পড়াশুনায় তা বাস্তবতা-বিবর্জিত না হওয়াই ভালো।